ফিচার ডেক্স
ভোলার মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত তুলাতলি গ্রামের শান্ত পরিবেশে মনোয়ারা বেগমের জীবনগাথা এক অনন্য সাফল্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এই সংগ্রামী নারীর একটি ছাগল থেকে শুরু হওয়া যাত্রা আজ হাজারো নারীর জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। কোনো বড় পুঁজি বা প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ ছাড়াই, মাত্র তিন হাজার টাকায় ভাইয়ের কাছ থেকে কেনা একটি ছাগল নিয়ে তিনি যে স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছিলেন, তা এখন একটি উজ্জ্বল বাস্তবতা। সনাতন পদ্ধতি ত্যাগ করে তিনি বৈজ্ঞানিকভাবে মাচা পদ্ধতিতে ছাগল পালনের পথ বেছে নিয়েছেন। এই পদ্ধতির মাধ্যমে তিনি শুধু নিজের জীবনের গতিপথই বদলে ফেলেননি, বরং পুরো তুলাতলি গ্রামের নারীদের জন্য হয়ে উঠেছেন এক আলোকবর্তিকা।
মনোয়ারার জীবন কখনোই সহজ ছিল না। স্বামীর হৃদরোগ তাকে ভারী কাজ থেকে দূরে রেখেছিল, ফলে সংসারের হাল ধরার দায়িত্ব এসে পড়ে তার কাঁধে। একটি ছাগল দিয়ে শুরু হওয়া এই যাত্রায় তিনি সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন তার ছেলে ও পুত্রবধূকে। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে ওঠা খামারটি এখন তাদের পরিবারের প্রধান আয়ের উৎস। আত্মবিশ্বাসে উজ্জ্বল মনোয়ারা বলেন, তিনি ভাইয়ের দেওয়া তিন হাজার টাকায় কেনা একটি ছাগল দিয়ে এই পথচলা শুরু করেছিলেন। আজ তিনি আর কারও দিকে তাকাতে হয় না। গত কোরবানির ঈদে বেশ কয়েকটি ছাগল বিক্রি করেও তার খামারে এখন নয়টি ছাগল রয়েছে। শুধু তাই নয়, তিনি এখন ছাগলের জন্য উন্নত জাতের ঘাসও চাষ করেন। চলতি বছর তিনি ষাট হাজার টাকারও বেশি মূল্যের ছাগল বিক্রি করেছেন, যা তার পরিবারকে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
মনোয়ারার এই সাফল্য তুলাতলি গ্রামে এক নীরব বিপ্লবের সূচনা করেছে। তার পথ ধরে গ্রামের অন্য নারীরা, যেমন সালমা বেগম, মিনারা বেগম, মরিয়ম, বিবি রাশিদা, এখন মাচা পদ্ধতিতে ছাগল পালনে ঝুঁকছেন। মিনারা বেগম বলেন, আগে তারা সাধারণ পদ্ধতিতে ছাগল পালতেন, তখন ছাগল প্রায়ই রোগে ভুগে মারা যেত। কিন্তু মাচা পদ্ধতির কারণে এখন রোগবালাই প্রায় নেই বললেই চলে, ফলে তারা লাভের মুখ দেখছেন।
এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন এবং গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত ‘আরএইচএল প্রকল্প’। স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা গ্রামীণ জন উন্নয়ন সংস্থা এই প্রকল্পের মাধ্যমে নারীদের কারিগরি পরামর্শ, প্রশিক্ষণ এবং মাচা তৈরির সম্পূর্ণ খরচ বহন করে সহযোগিতা করছে। ভোলা সদর ও বোরহানউদ্দিন উপজেলায় ইতোমধ্যে ৩৭৫ জন নারীর জন্য মাচা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। সংস্থার উপ-পরিচালক ও কৃষিবিদ আনিসুর রহমান বলেন, তাদের লক্ষ্য গ্রামীণ নারীদের মধ্যে টেকসই সক্ষমতা গড়ে তোলা। মাচা পদ্ধতি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায়ও কার্যকর। নারীদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, এবং তাদের আত্মবিশ্বাস দেখে তিনি আশাবাদী যে এই মডেল গ্রামীণ অর্থনীতিতে স্থায়ী পরিবর্তন আনবে।
ভোলা জেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. রফিকুল ইসলাম খান মাচা পদ্ধতির প্রশংসা করে বলেন, এটি একটি বিজ্ঞানসম্মত ও লাভজনক পদ্ধতি। এর মাধ্যমে অল্প জায়গায় বেশি ছাগল পালন করা যায়, এবং স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ এড়ানো যাওয়ায় রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়। গ্রামীণ জন উন্নয়ন সংস্থার এই উদ্যোগকে তিনি প্রশংসনীয় বলে উল্লেখ করেন। তিনি আরও জানান, সরকারিভাবে খামারিদের সব ধরনের পরামর্শ ও চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে।
একসময়ের অসহায় মনোয়ারা বেগম আজ একজন সফল খামারি ও উদ্যোক্তা। তার একটি ছাগল থেকে শুরু হওয়া খামার এখন শুধু তার পরিবারের জন্য নয়, বরং তুলাতলি গ্রামের নারীদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। তার সাফল্যের গল্প গ্রামীণ নারীদের মাঝে আলো ছড়াচ্ছে, যা বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে টেকসই পরিবর্তনের পথ দেখাচ্ছে।